আমার সিলেট
জাতীয়
৫ অক্টোবর, ২০২৫

ঢাকা-সিলেট সড়ক উন্নয়ন: সিলেটের নদীর বালি-মাটি তুলবে দেশীয় ঠিকাদাররা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেট
ঢাকা-সিলেট সড়ক উন্নয়ন: সিলেটের নদীর বালি-মাটি তুলবে দেশীয় ঠিকাদাররা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের শঙ্কা

ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে মাটি-বালি উত্তোলনের অনুমতি দিচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সিলেট অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদী, খাল, ছড়া ও বিল থেকে বালি উত্তোলন করবে চীনা মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রোর বাংলাদেশী উপঠিকাদার। বিপুল পরিমাণ বালি ও মাটি উত্তোলন করলে সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

ঢাকা-সিলেট করিডোর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০৯ দশমিক ৩২৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এডিবি। ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। বৃহৎ এ প্রকল্পের ১৩টি নির্মাণ চুক্তির মধ্যে প্যাকেজ নম্বর ১২/এ-এর মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো করপোরেশন। সিলেটের লালাবাজার (৭ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার) থেকে কাশিকাপন বাজার পর্যন্ত এ প্যাকেজের মোট দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বালি সরবরাহের চুক্তি করেছে দেশীয় ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ।

নথিপত্রে দেখা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর, সদর, চুনারুঘাট, বাহুবল, নবীগঞ্জ এবং সিলেট জেলার ওসমানীনগর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় অবস্থিত বিভিন্ন লোকেশনে বালি সরবরাহ করবে ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ। শুরুতে অনুরোধ জানালে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কুশিয়ারা নদীর শায়েস্তাগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বালি উত্তোলনে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে বিআইডব্লিউটিএকে অনুরোধ করা হয়। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার মৌজাগুলো বিআইডব্লিউটিএর নদীবন্দর সীমানার বাইরে থাকায় জরিপ করে অনাপত্তি প্রদান করা হয়। আবার নবীগঞ্জ উপজেলার বালি উত্তোলনের স্থানগুলো বালাগঞ্জ নদীবন্দর সীমানায় হওয়ায় সরাসরি ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজকে অনুমতি দেয়া হয়। যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এসব এলাকা থেকে কাঙ্ক্ষিত বালি উত্তোলনের পর সিলেট জেলার কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকেও বালি উত্তোলনের আবেদন করেছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘সাসেকের আওতায় ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি অবকাঠামো উন্নয়নে একটি মেগা প্রজেক্ট। সিলেট অঞ্চলটি নদী ও পাহাড়ের সমন্বিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে বড় প্রকল্প হিসেবে শুরুতে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া আছে। এখন মাঠ পর্যায়ে ভৌত কাজ শুরুর পর অনুমতিপত্র অনুযায়ী কাজ করলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু করার থাকবে না। তবে নদী থেকে বালি কিংবা মাটি উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবিদরা সাসেকের ঢাকা-সিলেট সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে সজাগ রয়েছেন।’

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও বাকি ১০টি প্যাকেজে বিভিন্ন স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বালি-মাটি সরবরাহের অনুমোদন পাচ্ছে। সব মিলিয়ে সিলেট অঞ্চলের হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় অন্তত ২০-২৫টি নদী থেকে এ প্রকল্পের মাটি-বালি ব্যবহার হবে। জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত বালুমহাল, অনির্ধারিত স্থান থেকে বালি উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে। যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা না গেলে একটিমাত্র সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোর প্রতিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন তারা।

সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আবদুল করিম কিম বলেন, ‘ছয় লেনের মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব মাটি ও বালি নদ-নদী, বিল, ছড়া থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। বিষয়টি সিলেট অঞ্চলের পরিবেশের জন্য ভয়ানক। এমনিতে সিলেটের বিভিন্ন নদী থেকে পাথর-বালি উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্ভোগ বেড়েছে। এখন সাসেক প্রকল্পের সম্পূর্ণ বালি-মাটি নদী থেকে উত্তোলনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের অধীনে বালি উত্তোলনের বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজরদারি না থাকলে সাসেক রোড প্রকল্পটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় পরিবেশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে।’

এ বিষয়ে জানতে সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ কে মোহাম্মদ ফজলুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বালি উত্তোলনে যুক্ত প্রকল্পের উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট করিডোর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনটি প্যাকেজের (৯, ১০ ও ১২/এ) বালি-মাটি ভরাটের কাজ পেয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএসহ সরকারি সব সংস্থার কাছ থেকে যথাযথ অনুমোদন নিয়েই বালি উত্তোলনের অনুমতি নেয়া হয়েছে।’ এতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর সিলেট অঞ্চলের সীমানায় প্রকল্পের সাতটি প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশীয় উপঠিকাদারদের বালি উত্তোলনের অনুমতি দিতে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কার্যালয়কে চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালক এ কে মোহাম্মদ ফজলুল করিম। প্যাকেজ ৬ ও ৮-এর জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো বালির আবেদন না থাকলেও প্যাকেজ ৭-এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরাসরি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে আবেদন করে। অন্যদিকে প্যাকেজ ৯, ১০ ও ১২/এর জন্য মেসার্স ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের আবেদন করেছে। এছাড়া প্যাকেজ ১১-এর (শেরপুর ব্রিজ টোল প্লাজা থেকে কাশিকাপন বাজার) জন্য মেসার্স তালুকদার এন্টারপ্রাইজ ওসমানীনগর প্রকল্প এলাকার জন্য বালি উত্তোলনের আবেদন করে। তবে ২০২৩ সালে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোর বেশ কয়েকটি নদীবন্দর ঘোষিত হওয়ায় বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে বালি উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, প্রকল্পের প্যাকেজ নং ১১ বাস্তবায়ন করছে তুরস্কের ইএনইজেড ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। অন্যদিকে ১২/এ সিনোহাইড্রো, প্যাকেজ ১০ করছে চায়না রেলওয়ে ফার্স্ট গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড, প্যাকেজ-৯ বাস্তবায়ন করছে যৌথভাবে চীনা প্রতিষ্ঠান সিপিসি-সিআরএফজে, প্যাকেজ ৮ চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও দেশীয় স্পেক্ট্রা, প্যাকেজ ৭ চীনের সিচুয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ ও দেশীয় বিটিসি এবং প্যাকেজ ৬ বাস্তবায়ন করছে দেশীয় মীর আখতারের সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠান সিএইচএসআইইটিসি। প্রকল্পের সিলেট অঞ্চলের সাতটি প্যাকেজের মধ্যে ৯, ১০, ১১ ও ১২/এ বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ মাটি ও বালির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যা স্থানীয় উৎসের নদী, খাল ও ছড়া থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করছে বিদেশী ও দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো উপঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় নদী থেকে বালি উত্তোলনের চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

সূত্র: বণিক বার্তা

মতামত (0)